
আমাদের অসম্ভব প্রিয় মানুষ মানব দরদী মহান বাঙালি পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সর্ব অর্থেই প্রাতঃস্মরণীয় মনস্বী, মনীষীমানব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই প্রয়াত হন। ‘মানুষের কল্যাণে সতত নিবেদিত মানুষ’টির স্মৃতির প্রতি জানাই অন্তরের অন্তস্থল থেকে নিখাদ ভালোবাসা, বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। উল্লেখ্য যে, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর (১২ আশ্বিন, ১২২৭ বঙ্গাব্দ), মঙ্গলবার পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন হুগলি জেলার (অধুনা পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা) বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আমরা এমন এক অন্ধকার সময় যাপন করছি, এই নিশিযাপনকালে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতোন মেরুদণ্ড সম্পন্ন মানুষদের, জীবন দার্শনিকদের উপস্থিতি প্রয়োজনীয়তা খুব বেশি তীব্রভাবেই অনুভব করছি। কঠিন সত্যকে যুক্তিবাদে-বিবাদে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান নি:সন্দেহে স্মরণীয়।
পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রাতঃস্মরণীয় মনীষী। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে অনেক যুগ প্রবর্তক মহাপুরুষের জন্ম হয়েছিল; ঈশবরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অসামান্য। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্ম ও মহাপ্রয়াণের পর দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হচ্ছে। এই দীর্ঘ সময়ে কালের ধুলোয় বহু ব্যক্তিত্ব, বহু ঘটনা ঢাকা পড়েছে। কিন্তু বিদ্যাসাগর আজও আমাদের জীবনে ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল। বাঙালির জীবনলোক ও মননলোক জুড়ে তাঁর সজীব, আলোকিত উপস্থিতি। বাঙালির শিক্ষা, নারী জাগরণ, ভাষা ও সাহিত্যের নিরলস সাধক এই মানুষটি আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন যুক্তিবাদী মন নিয়ে। সময়ের এই দীর্ঘ ব্যবধান সত্ত্বেও বিদ্যাসাগরকে নিয়ে তাই আজো আমাদের ভাবনা-চিন্তায় ছেদ পড়েনি। প্রতিটি বাঙালির উচিত বিদ্যাসাগরের জন্ম ও প্রয়াণ দিবসকে স্মরণ করে তাঁর মননশীল মানবিক যুক্তিবাদী চেতনাকে সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে অন্ধকারের সমাজকে আলোকিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা। বিদ্যাসাগরের জন্মদিনে তাই কেবলি মনে পড়ছে কবিগুরুর মহান বাণী – ‘রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি’।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সহজ সরল জীবনযাপন করতেন। সাদাসিদে পোশাকে গায়ে মোটা চাদর এবং চটিজুতা ছিল তাঁর একমাত্র পরিচ্ছদ। বিরল গুণের অধিকারী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ‘আমি যে দরিদ্র বাঙ্গালী ব্রাহ্মণকে শ্রদ্ধা করি তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।’ বিদ্যাসাগর ছিলেন পরের দুঃখে অতি কাতর। মহকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তকে তিনি বিভিন্ন সময়ে প্রচুর অর্থ সাহায্য করেন। কবি নবীনচন্দ্র সেনও যৌবনে বিদ্যাসাগরের অর্থে লেখাপড়া করেছিলেন।
বিদ্যাসাগরের একটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি হল সমাজ সংস্কারমূলক কাজ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। তিনি দুঃস্থমহিলাদের সেবা সহায়তা দিয়ে বাঁচানোর জন্য জন্য “হিন্দু ফ্যামিলি গ্রাচুয়িটি ফাণ্ড” গঠন করেন। তিনি চিরদিন কুসংস্কার, গোড়ামি আর ধর্মন্ধতার বিরুদ্ধে আপোষহীনভাবে লড়াই করে গেছেন। বাঙালি জাতি সর্বপ্রথম বড় হবার, যোগ্য হবার, মানবিক হবার, আধুনিক প্রগতিশীল ও বিশ্বজনীন হবার সর্বপ্রথম দৃষ্টান্ত খুঁজে পেয়েছিল বিদ্যাসাগরের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সম্বন্ধে বলেছেন তিনি হিন্দু ছিলেন না, বাঙ্গালী বা ব্রাহ্মণ ছিলেন না, ছিলেন ‘মানুষ’। এই মন্তব্যের তাৎপর্য অতলস্পর্শী। কারণ কারো যথার্থ “মানুষ” হওয়া অত সহজ কথা নয়। তিনি আরো বলেছেন, ‘তাহার মহৎ চরিত্রের যে অক্ষয় বট তিনি বঙ্গভূমিতে রোপণ করিয়া গিয়াছেন, তাহার তলদেশে জাতির তীর্থস্থান হইয়াছে।’
সংস্কৃত পন্ডিত, লেখক, শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক, জনহিতৈষী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (২৬শে সেপ্টেম্বর, ১৮২০- ২৯ জুলাই, ১৮৯১) আক্ষরিক অর্থেই একজন আলোকিত মানুষ ছিলেন, আদর্শ মানব ছিলেন। বিদ্যাসাগরের জীবন কেটেছে বাংলার ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিকালে। দারিদ্র্য ও শোষণ বাঙালির সমাজজীবনকে ক্ষয় করে ফেলেছিল। শিক্ষা, ইংরেজ শাসন ও সামাজিক কুসংস্কার ইত্যাদি বিষয়ে রামমোহন রায় থেকে শুরু করে অনেকেই বাংলার নবজাগরণে ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন শহুরে বণিক পরিবারের। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন বিদ্যাসাগর। তিনি ছিলেন গ্রামের ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। সাত ভাই আর তিন বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। মায়ের প্রতি ছিল বিদ্যাসাগরের অগাধ শ্রদ্ধা। মায়ের প্রতিটি ইচ্ছা অকাতরে পূরণ করতেন। তাঁর মাতৃভক্তি নিয়ে অনেক জনশ্রুতিও শোনা যায়। বাংলা গদ্য সাহিত্য যার হাতে পেল গতি ও শ্রুতি তিনিই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সাহিত্যিক হিসেবেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রয়েছে যথেষ্ট অবদান। তিনি সাহিত্যে সৃজনী প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি যখন অধ্যাপক ছিলেন, তখন বাংলায় উন্নত পাঠ্য পুস্তকের অভাব বোধ করেছেন। নিজের সাহিত্য প্রতিভাবলে বাংলা গদ্যের ভান্ডার শক্ত করেছেন তার জন্যই বাংলা গদ্যরীতি আপন পথ খুঁজে পায়। আর এ জন্যই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হয়। এই তিনিই আবার বৃটিশ ভারতে বাঙালির সমস্যাসমূহ টের পেয়েছিলেন বলেই সেসব সমস্যা সমাধানে আমৃত্যু নিরন্তর কাজ করে গেছেন। জীবনে কম কষ্ট পাননি তিনি তাঁর আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে। নিজ পরিবার, সমকালীন সমাজ এবং ওপনিবেশিক শাসকদের কাছ থেকে। অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থা থেকে অর্থনৈতিকভাবে বেশ সম্পদের অধিকারী হয়েও তিনি ব্যক্তিগত ভোগ বিলাসীতায় কখনো নিজেকে নিমজ্জিত রাখেননি। বিত্ত অর্জনে কষ্ট করেছেন কিন্তু চিত্তের উদারতায় মানব কল্যাণে ব্যয় করতে কখনো সংকোচ কিংবা দ্বিধা করেননি। ফলে সমকালেই তিনি জ্ঞানের বা বিদ্যার সাগরের পাশাপাশি করুণার সাগর হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেছিলেন। বিদ্যাসাগর উনিশ শতকে অবিভক্ত বাংলায় শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তিনি হিন্দু সমাজের বিধবা বিবাহ প্রথা চালু করেন। তার প্রচেষ্টায় ২৬ জুলাই ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ আইন পাস হয়। নিজের ছেলের সাথে এক বিধবা কন্যার বিয়ে দিয়েছিলেন। যাতে অন্য হিন্দুরাও উৎসাহ বোধ করে।
তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া, অনুশীলন, দেশ, আনন্দবাজার পত্রিকা, দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক ইত্তেফাক, ইন্টারনেট।